অজানা রুপকথার দেশে
রুপকথা
আখন্দ জাহিদ
গল্প পোকা আরিব । ছোট বেলা থেকেই দাদা- দাদি, নানা-নানী থেকে শুরু করে রক্তীয় কিংবা আত্বীয় যে কোন সম্পর্কের লোকের কাছে সুযোগ পেলেই গল্প শোনার বায়না ধরে বসতো। তবে আবিরের প্রিয় গল্প বন্ধু ছিল তার দাদি। কারণ দাদিই তাকে অন্যন্য সবার চাইতে আলাদাভাবে গল্পের মাধ্যমে বাস্তবতা থেকে এক ভিন্ন জগতে নিয়ে যেতেন। অচেনা - অজানা সব রুপকথার দেশে। আর সেই রুপকথার গল্প শোনার আশায় দাদির কাছে গিয়ে কারণে কিংবা অকারণে দাদির পা টিপে দিত আবির। দাদির জন্য কাচা হাতে নিজেই পান বানিয়ে দাদির মুখের সামনে তুলে ধরে সময়ে অসময়ে গল্প শোনার বায়না ধরত সে। দাদিও তার এই গপো আবিরকে খুব আদর করতেন। আবিরকে যে গল্প পোকা বিশেষন দেয়া হয়েছে সে দায় আসলে অন্য কারো নয়। আবিরের দাদিই তাকে এই বিশেষনে বিশেষায়িত করেছেন। গল্প পাগল আবিরের নামকে পরিবর্তন করে গল্প পোকা রেখেছেন তার দাদি। আর ডাকার সুবির্ধাতে সেই নামটিকে আরো সংক্ষিপ্ত করে দাদি আবিরের নাম দেন গপো ৷ অনেক আদর আর ভালোবাসা দিয়ে আবিরকে গপো বলে ডাকতেন তার দাদি।
সময়ের সাথে সাথে নাকি মানুষের সব কিছু পরিবর্তনশীন। শারিকরীক গঠন, রুচি, চিন্তা ভাবনা, এমনকি নিজের হলেও যার উপরে নিজের ক্ষমতা থাকে না সেই মনটিও। আবিরের বেলায়ও তাই হয়েছে। গপো আবির সেই গল্প আর রুপকথার বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে ধীরে ধীরে বাস্তবময় হয়ে উঠে। শৈশব আর কৈশরের কল্পরাজ্য ছেড়ে এখন সে বাস্তব জীবনে নিজের মত করে একটি রাজ্য তৈরি করতে শুরু করেছে। তবে সেই রাজ্যের রাজা নিজেকে কল্পনা করলেও রাণী কে হবে সে বিষয়ে কোন চিন্তা বা কল্পনা নেই আবিরের৷ তবে ছোট বেলা দাদির মুখে রুপকথার গল্প শুনে প্রিয়দর্শনী অনেককেই মনে মনে তার রাণী হিসেবে কল্পনা করতো। কিন্তু আবির না বুঝতে পারলেও তার গল্প বন্ধু দাদি তার এই প্রিয়দর্শীনির কল্পনা ঠিকই ধরতে পারতেন। তাই গল্প শেষে গপো আবিরকে দাদি সবসময় বলতেন-
ভিন গ্রহের মানুষ তারা
যতই করো আশা
ভালোবাসা মিথ্যা তাদের
সবই রুপকথা.....
কিন্তু আবির তখন এই কথার কিছুই বুঝতে পারত না। তবে কথাটি আবিরের কানে এখনো মাঝে মাঝে বেজে উঠে ৷ তবে সে সকল সময়ের কথাগুলি মনে হলে আবির বোকার মত আনমনে হেসে উঠে। একাকি কাটানো সময়টুকুতে হয়তো মানুষ নিজেকে অতি চালাক না হয় খুব বোকা ভাবে। কিন্তু আবিরের ভবনায় এখন সেই রকম কিছুই আর আসে না। তবে একাকী যেটুকু সময় পায় মাঝে মাঝে তার রাজ্যের রাণী কি রকম হবে! তাকে বুঝতে পারবে কিনা! এসব কিছু নিয়ে ভাবতে ভাবতে সে সময় কেটে যায়।
নিজ রাজ্যে রাণীর ভাবনা আসলেও আবির সেই ভাবনটাকে এখন আর খুব বেশি পাত্তা দেয় না। কারণ আবির এখন লেখাপড়ার গন্ডি শেষ করে জীবন বাস্তবতার মুখোমুখি। তাই এসব কল্পনা এখন আর তাকে মানায় না সেটা ঠিকই বুঝতে পারে। তার একটা কারণও অবশ্যই আছে। আবির যখন উচ্চ মাধ্যমিকে পড়তো তখন ছোট বেলার কল্পনায় আকা ছবির সাথে কাউকে না পেলেও জীবন স্বপ্নে একজনের দেখা পেয়েছিল। কিন্তু সে স্বপ্ন আবিরের জীবনে গোধূলি বেলার মতই ক্ষণস্থায়ী হয়েছিল। সেই থেকেই স্বপ্ন দেখা বা কল্পনা করা ভুলে গিয়ে আবির বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। আর যখন কোন স্বপ্ন বা কল্পনা এসে দরজায় কড়া নাড়ে তখনই আবিরের সেই ক্ষণস্থায়ী গোধূলি সময়ের কথা মনে পড়ে যায়। তাই সে এখন এসব কোন কিছুকে আর পাত্তা দেয় না।
শুরুতেই যে বলেছিলাম সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই পরিবর্তনশীল। আবিরও বেলায় এদিক দিয়ে তেমনটাই ঘটেছে। যেমনটা বলেছিলাম মালিকানা নিজের হলেও মনের উপর যেমন নিজের ক্ষমতা থাকে না। মনকে কোন শিকল দিয়ে আটকে রাখা যায় না। গল্প পোকা, স্বপ্ন পিয়াসু আবিরও সেটা পারেনি। হঠাৎ একদিন -রুপকথার সেই গল্পের মতই হুট করে তার জীবনে নতুন একজনের আগমন ঘটে। আশ্চর্যের বিষয় তার নামটিও ছিলো কথা। আবিরের কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। সে কথাকে জিজ্ঞেস করছিলো সত্যি তুমি স্বপ্ন নও তো! আমার সেই গোধূলি সময়ের মতো !
তখন কথা বললো ' আরে নারে বোকা - আমি শুধু তোমারি। আমি তোমার সেই স্বপ্নের রাণিটি হবো। তার জন্যইতো নতুন করে আমাদের আবার পরিচয়। নতুনভাবে বলতে আবির কথাকে প্রথম দেখেই বলেছিলো তোমায় এত আপন মনে হচ্ছে কেন বলতে পারো? কেমন খুব চেনা চেনা লাগছে? এর আগেও কি কোথাও আমাদের দেখা হয়েছিল? তখন কথা মিষ্টি হেসে বললো, তোমার সেই ছোট বেলার কল্পনাকে আকা ছবির রাণিটি যে আমিই ছিলাম। আবির ড্যাপড্যাপ করে কথার দিকে তাকিয়ে বলে আচ্ছা আমি তোমাকে কি নামে ডাকবো বলো - জবাবে কথা বললো তোমার যা খুশি তাই। তবে তোমার মুখে বউ ডাক শোনার খুব ইচ্ছে আমার।
আবির কথাকে নানা নামে ডাকলেও বউ নামে ডাকতে ভুল করতো না। কথার আগমনে জীবন বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করে চলা আবিরের অগোছালো জীবনে ধীরে ধীরে পরিবর্তন শুরু হতে লাগলো। আবিরের সেই পরিবর্তন কেউ লক্ষ্য করতে না পারলেও সে নিজে ঠিকই উপলব্ধি করতে পারতো। আবিরের বাস্তবময় জীবনে কথার আগমন যেন সত্যিই এক রুপকথার গল্পের মতো। যা কেউ শুনলে কখনো বিশ্বাসই করবে না। কিন্তু মানুষের বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের ধার ধারে না আবির আর কথা। ধীরে ধীরে একে অন্যের খুব আপন হয়ে উঠে। সমাজের সকল বাধাকে উপেক্ষা করে পরস্পর এক হবার সিদ্ধান্ত নেয়। এক মুহূর্তের জন্যও কেউ কাউকে ভুলে থাকতে পারে না। আবির ছোটবেলা থেকে খুবই আবেগপ্রবণ। তাই কথার কাছেও নিজের আবেগ সামলাতে পারেনি। কিন্তু জীবন পথে একসাথে চলার কথা দিলেও কথা যখন বুঝতে পারে আবির তার প্রতি দুর্বল তখন কথা তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। আবির কিছু জানতে চাইলে উত্তর না দিয়ে কথা ঘুরিয়ে অন্য কথায় চলে যায় কথা। বোকারাম আবেগপ্রবণ আবির কথার সকল অবহেলা সহ্য করে নিজের কষ্ট বুঝতে দেয় না কথাকে। ইতিমধ্যে আবির বুঝে গেছে কথার কাছে তার আবেগ, ভালবাসা আর কষ্টগুলি মূল্যহীন। কথাকে নিয়ে দেখা আবিরের সব স্বপ্ন কেন যেন সেই গোধূলি সময়ের মত ক্ষণস্থায়ী মনে হতে লাগলো । কথা কেন এমন করছে! আবিরের দোষটা কি শুধুই ভালোবাসার পাগলামি! বাস্তবতা ছেড়ে দিয়ে আবেগময় হয়ে উঠা! সত্যিই কি কথা অন্তরজুড়ে ছিল অাবির? নাকি সব কিছুই মরিচিকা! এ সকল প্রশ্নের উত্তর খুজতে থাকে অাবির। কিন্তু কিছুতেই কোন উত্তর খুঁজে পায় না সে।
বাইরে তখন হঠাৎ একটা বিকট শব্দ হয়। সেই শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আবিরের।
ঘড়ির কাটার অবস্থান তখন রাত ৩:২৫ মিনিটে। ঘুম ভেঙে সে নিজেকে চিমটি কাটে। এতক্ষণ কি সত্যিই কথাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিল! তাহলে কি কথা শুধুই তার সেই ছোটবেলায় কল্পনায় আকা রুপকথার রাণীই ছিল! তখন মনে মনে আবির ভাবে কিছু পারি আর না পারি কারো হই বা নাই হই স্বপ্ন দেখার সাধ্যতো রয়েছে। সেটাকে কেড়ে নিবে কে! এমন সাধ্যই বা কার! বেঁচে থাকার সম্বলই যে এখন শুধুই স্বপ্ন! হোক সেটা বাস্তব নয়তো কোন রুপকথা।
Comments
Post a Comment